ঘাতকের পদধ্বনি


রাণুর মা হঠাত এসে ডাক ছাড়লো-‘বাবু ! বাবু ! একটু দরজা খুলুন ।

  চাকরির সুবাদে এখানে আসার পর থেকে সবাই আমাকে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করে। রাণূর মা তো প্রায় সময় আপন জনের মতন আসা যাওয়া করে। এক আত্মীয়তার বন্ধন ক্রমে ক্রমে সুদৃঢ হয়ে ওঠেছে সেই আসার পর থেকেই। আমিও অবসর কাটাতে ওদের ঘরে যাই। চা জলযোগ তো নৈমিত্তিক ব্যাপার। মাঝেমাঝে রাণুকে পাঠের দু একটা কঠিন বিষয় সমাধান করতে সাহায্য করি। এতে অন্তরঙ্গতা আরও বেড়ে উঠেছে।আজ হঠাৎ মাসি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে ডাক ছাড়ছে কেন ? ভাবলাম হয়তো টাকা পয়সা ধার চাইতে এসেছে। দরজা খুলে দিয়ে বললাম-কী হয়েছে মাসি ?
আমাকে কোন উত্তর না দিয়ে বলল- শিগগির চলুন আমাদের বাসায় কাজ আছে ।
-
         কী কাজ ? কারো অসুখ বিসুখ নাকী ?

-         না না গেলে দেখবেন । তাড়াতাড়ি চলুন।

দরজায় তালা লাগিয়ে অগত্যা তার পেছনে পেছনে চললাম। কোয়ার্টার থেকে ওদের বাসা বেশি দূরে নয় এক ফার্লং হবে ।
বাসায় পৌছে দেখি একটা যুবতী মেয়ে বারান্দায় বসে আছে । সামনে একটা ভাঙা সুটকেস। ফাঁক দিয়ে কিছু ফাটাটুটা কাপড় আর পলিথিনের পুটলা বেরিয়ে পড়েছে ।

রাণুর মাকে জিঞ্জেস করলাম- মাসি কী ব্যাপার? বলল-বাবু! আজ হাটের দিন। কোত্থেকে এই মাইয়াডা আইসা আমাদের ঘরে আশ্রয় লইছে। ভালভাবে কথাও বলতে পারে না , যা কয় পুরা বুঝন যায়না।কই থাইকা আইছে কইতেও পারেনা ।শুধু হাত ঘুরায়। জিজ্ঞাসা করছিলাম হিন্দু না মুছলমান?যা বলল কিছুই বুঝা গেল না ।  তারপর সুটকেস থাইকা একটা তসবির মালা বাইর করি দেখাইল। বুইজলাম মাইয়াটা মুছলমান।আপনাদের লোক বলেই আপনাকে ডাইকা আনলাম বাবু। এর একটা সাহারা করুন বাবু। দিনকাল ভালা নায়। আইজকালকুর যা পোলাপান... ।

আমি তো কোয়ার্টারে একাই থাকি। পাশের ঘরে চৌকিদার বাহাদুর আর তার নিঃসন্তান স্ত্রী। কী করবো ভেবেই পাইনা।

রাণুর মাকে বললাম – মাসি আমি কী করবো বলুন।

রাণুর মার সেই এক কথা – দেখুন বাবু মাইয়াডা যদি হিন্দু অইত আমরা যেকোন মতে আশ্রয় দিতাম। কোন অসুবিধা আছিল না। তাও যুবতী মাইয়া। শরীর দেইখা মনে অইতাছে কোন পাষণ্ডয় কাম ঘটাইদিছে। বাবু আপনে ধার্মিক মানুষ। উপরআলায় আপনার ভালা করবা। মাইয়াডারে একটা গতি করুন।

ভাবলাম সত্যিই তো! ভূপেন হাজরিকার সেই অমৃত ছন্দ মনে পড়ে গেলো – মানুষ মানুষের জন্যে... । তাহলে আমি অপেক্ষা করবো কেন? মনে মনে স্থির করলাম মেয়েটাকে গ্রামের ঘরে নিয়ে যাবো। মা বাবা গ্রামবাসীরা মিলে যা করেন একটা সদগতি নিশ্চয় হবে।
মাসিকে বললাম – আজ মেয়েটাকে তোমাদের ঘরে রাখো। কাল সকালের বাসে আমি ওকে ঘরে নিয়ে যাবো।

কুমাছড়ার এই পিডাব্লিউডি কোয়ার্টারে দুবছর কেটে গেলো। আমার গ্রাম থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। এখানে একাত্তরের শরণর্থী হয়ে আসা গোটা দশেক বাঙালি পরিবার। বেশীরভাগ কাছারি বর্মন সম্প্রদায়। একটু উপরে পুঞ্জিতে মিজো ও খাসিয়ার বসবাস। দুই কিলোমিটার উত্তরে মুসলমান বস্তি। এখানে শুধু আমিই একা একজন। কিন্তু বাঙালি হিসাবে ওরাই আমার আপনজন হয়ে উঠেছে। এই একাত্মতা কোন ধর্মীয় প্রাচীর বিভাজন করতে পারে না।

সকাল সাতটায় বাস ছাড়বে। ভোরে ওঠে ফজরের নামাজ সেরে তৈয়ারি করছি। দেখি রাণুর মা মেয়েটাকে নিয়ে হাজির। পরনে নতুন শাড়ি-ব্লাউজ। হাতে সেই ভাঙা সুটকেস। চুলগুলোও আঁচড়ানো। বলল—বাবু কাল মাইয়াডাকে নদীত নিয়া ভালো কইরা নাওয়াইছি। আমার পুরোনো শাড়ি-ব্লাউজ ওকে পরাই দিছি। ময়লা কাপড়ে কেমন কইরা বাবুর লগে যাবে লজ্জা লাগবেনা!

মেয়েটার চোখে চেয়ে দেখি এক আনন্দের অশ্রু ঝিলিক দিচ্ছে।

বাসে বসে ভাবলাম—এখনো মানুষ মানুষের জন্য ভাবে।মাসিদের নিম্নবিত্ত পরিবার। নিত আনে নিত খায়। এক অজানা অচেনা ভিনধর্মী কিশোরীর  জন্য প্রাণ উথলে ওঠলো। নিজের ভাল কাপড়্গুলো পরিয়ে দিয়ে স্নানটান করিয়ে দিয়ে কি সুন্দর করে সাজিয়ে দিল মেয়েটিকে। মানুষ আছে বলেই এখনও পৃথিবীটা ঘুরছে।

সদরঘাট পৌছেই মেয়েটাকে সংগে নিয়ে নেমে গেলাম। কাছাড় কলেজ স্ট্যাণ্ড থেকে ভাগা যাওয়ার বাস ধরতে হবে ।ইসলামাবাদ পৌছতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগবে ।রাস্তা যা খারাপ। দুটো সিটের টিকেট করে গাড়িতে বসে পড়লাম। মেয়েটাকে কিছু খাওয়াতে চাইলাম ইশারায় অস্ফুট শব্দে বলল-লা বাবু লাগব না

জানালার ধারে বসে আছি। নিজে এখনও বিয়ে থা করিনি ।ঘরে মা-বাবা-দাদারা রয়েছেন। নতুন মেয়েটাকে দেখে আবার কী ভাববেন! গ্রামের লোকগুলোইবা কী মনে করবে! হাজারো প্রশ্ন মনের মধ্যে ওঠানামা করছে। কখন ঘুম এসে গেলো।

কন্ডাক্টরের চিৎকারে ঘুম ভাঙলে দেখি এসে পড়েছি গন্তব্যস্থানে। আমার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তাকেও আমার সঙ্গে চলতে বললাম। বাড়িতে প্রবেশ করতেই দেখি উঠোনে মা দাঁড়িয়ে আছেন। নবাগতাকে সঙ্গে দেখে বলে ওঠলেন
-     
            কীরে ব্যাপার কী? তোর সঙ্গে মেয়েটা কে?

আমি মাথা নীচু করে বললাম—মা এক মহাবিপদি নিরাশ্রয়ীকে এনেছি মা। বলবো সব বলবো। আগে একটু জলভাত দাও মা।

মাকে সব কথা খুলে বলে যখন উত্তরের অপেক্ষায়। মা চুপ করে গেলেন। অনেক্ষণ পরে বললেন—পরের আপদ ঘরে তুলে যেন বিপদ না আসে।

সন্ধ্যার পর বাবা যখন ঘরে ফিরে এলেন মায়ের কাছ থেকে সব কিছু শুনলেন, আমাকে শুধু ডেকে বললেন—মেয়েটাকে এনেছিস বেশ ভালোই করেছিস তবে কাল গ্রামের ময়মুরব্বীদের বিষয়টা জানিয়ে প্রয়োজন হলে থানায় ইনফর্ম করে রাখতে হবে, না হলে বাবা আবার কোন ঝামেলায় পড়ে যেতে পারি।

বাবার আশ্বাসে স্বস্থি ফিরে পেলাম। পরদিনই আমি কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলাম। মেয়েটার আশ্রয়ের কথা শুনে মাসির মুখে কী হাসি। যেন শত পূণ্যের কাজ সেরে এসেছি। পরের সপ্তাহে ঘরে ফিরে জানলাম থানায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। ইনচার্জ বাবাকে মেয়েটার দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন। রাত্রে মা এসে বললেন—মেয়েটাকে তো এনেছিস তবে ওর শরীর খারাপ।

নিয়মিত খেয়েদেয়ে ধীরে ধীরে মেয়েটি আরো স্বাস্থ্যবতী ও রূপসী হয়ে উঠলো। মায়ের কামকাজে কিছু কিছু সাধও দেয়। অস্পষ্ট শব্দে গল্পগুজব করতে চায়।  মাঝে মঝে  হাতির কথা বলে। মাকে বলে হাতি –টাকা-বহুত-বড় ঘর। আমাকে মারছে।

তার হাত পিঠ দেখিয়ে কাঁদে।মাও বলেছেন-ওর শরীরে মারপিটের দাগ রয়েছে।

সেদিন রোববার। মায়ের সঙ্গে আমি ঘর থেকে চাতালে ধান মেলে দিচ্ছি। মেয়েটাও ধান ঘেঁটে দিচ্ছে। এমন সময় বাবা হাঁক দিলেন—সোয়েব এসেছেরে। ওকে চা শরবত দাও। মা চলে গেলেন ঘরে সোয়েব চাচার ঘর সুদূর রাজনগরে। ধনী ঘরের লোক। বাবার সম্পর্কিত ভাই। দুটো হাতি আছে ওদের। বনকামে খাটিয়ে প্রচুর উপার্জন করেন। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসেন আমাদের ঘরে। বাবার সঙ্গে বেশ ভাব। আজো বৈঠকখানায় বসে গল্পগুজবে ব্যস্ত।

মেয়েটাকে চাতাল থেকে নিয়ে ঘরে ঢুকছি। নতুন মানুষটাকে দেখে মেয়েটা হঠাৎ কেমন হয়ে গেল। চোখাচোখি হতেই তার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো। মায়ের কাছে গিয়ে হাত দিয়ে  ইশারা করে বিড়বিড় শব্দে কী বলল। মা তাকে শান্ত করতে যতই চেষ্টা করেন সে অস্থির হয়ে বলতে থাকলো—ওই...ওই মাববে... মাববে...।

সোয়েব চাচা মাকে ডেকে বললেন—ওকে তোমরা কোথায় পেলে? মা সমস্ত কাহিনি শুনিয়ে বললেন—মাস দেড়েক হয়ে গেছে মেয়েটা এখানে আছে।

সোয়েব চাচার চেহারা বদলে গেলো। বললেন – ও আমার কাজের মেয়ে ছিলো। জঙ্গল থেকে আসার সময় ওকে পেয়ে নিয়ে এসেছিলাম। বদমাসটা ঠিক নয়।  মেয়েটার স্বভাব মোটেই ভালো নয়। ওকে রাখলে বিপদে পড়বে।

দুপুরের ভাত খেয়ে সোয়েব চাচা চলে গেলেন। মেয়েটা সোয়েব চাচার দর্শনের পর থেকে কী এক মনমরা হয়ে গেলো। ভাতও খেতে চায় না। চুপিচুপি কাঁদে। মা অনেক বুঝালেন কিন্তু


তিনদিন পর মা ভোরে উঠে দেখেন মেয়েটার বিছানা খালি পড়ে রয়েছে। সুটকেস কাপড়চোপড় যা ছিলো মেয়েটার তাও উধাও। গ্রামের আশেপাশে খোঁজখবর করেও কোন সন্ধান পাওয়া গেলো না। অবশেষে নদীর ঘাটে পাওয়া গেলো সেই সুটকেস আর পুরনো কাপড়ের গাঁট। সেই তসবির মালা।

Comments